গল্প- শিখন্ডী’র অন্য পণ

শিখন্ডী’র অন্য পণ
– দ্যুতিপ্রিয়া বন্দোপাধ্যায়

 

 

“আরে এই যে শুনছেন! ওইদিকে একটু সরে দাঁড়ান তো! সকাল সকাল যতসব উটকো ঝামেলা।”
ভিড় বাসে পিছন থেকে একজন ভদ্রলোকের গলা…অবশ্য এটা নতুন কিছু না… সমাজে ওর মতো মানুষরা যে কোনো ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না সেটা ভালো করেই জানে শিখন্ডী, মানে শিখন্ডী বনলতা দত্ত. বনলতা নামটা অবশ্য শিখন্ডীর মায়ের নাম…

তথাকথিত এক উচ্চ বংশে জন্ম শিখন্ডীর, সম্ভ্রান্ত পরিবার.. যখন তিনবারের বারও ছেলে হলো না তখন পরিবারের সবার মুখে আঁধার নেমে এলো। গুরুজনদের গলা দিয়ে ভাত নামানোর জন্য পঞ্চাশের স্বনামধন্য শ্রী দেবাশীষ দত্ত এবং ওনার বয়সের তুলনায় দশ বছরের ছোট সহধর্মিণী শ্রীমতি বনলতা দেবীর আরো একবার চেষ্টা করলেন। দেবাশীষ বাবুর বিধবা মা পাড়ার জাগ্রত মা বিপদতারিণীর কাছে মানত করলেন, “দেখো মা! এবার যেন একটা বংশ প্রদীপ পাঠিও মা.. কূলে বাতি দেওয়ার কেউ নেই মা।” যাই হোক- দশ মাস দশ দিন পর বনলতা দেবী লেবার রুমে। আগের তিনবারের তুলনায় প্রসব বেদনাটা যেন সত্যিই ভীষণ বেশি। বয়সের বাধাটা নিজে বুঝতে পারলেও বাকিদের কাছে ছিল “ছেলে হওয়াতে গেলে একটু তো কষ্ট পেতে হবে..!” টানা আধা ঘণ্টা ধরে সমস্ত কষ্টকে দাঁতে দাঁত চেপে যখন বনলতা দেবী একজন বালকের জন্ম দিলেন তখন পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে গেলো। ঠাকুমা বড়ো শখ করে নাতির নাম রাখলেন, “দীপজ্যোতি দত্ত”

দীপের দশ বছরের জন্মদিনটা পেরোনোর পর পরই দেবাশীষ বাবু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলেন যে তাঁর ঘরে কোনো ছেলে না বরং চতুর্বার কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য রকমের।
জন্মের পর থেকেই ও একটু অন্য রকমের বলে শুধু বাবার বাড়ি না মায়ের বাড়িতেও ওকে কেউ গ্রহণ করে নি। অগত্যা নিরুপায় বনলতা দেবী বারো বছরের দীপজ্যোতিকে নিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন দার্জিলিংয়ের এক ছোট্ট গ্রামে,”তিনচুল” সেখানেই ওর দীপজ্যোতি থেকে শিখন্ডী হয়ে ওঠা… সেখানেই ওর বুঝতে শেখা যে আর পাঁচটা মানুষের থেকে ও কতটা আলাদা…ওদের মতো মানুষদের অনেক নাম আছে, তবে ভালো ভাবে বললে ওদের মতো মানুষগুলো হলো ভগবান শিব-পার্বতীর অর্ধ-নারীশ্বর রূপের অংশবিশেষ।

ভিড় বাসে একটু এদিক ওদিক করে কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে এককোনায় এসে দাঁড়ালো শিখন্ডী…. পরনের শাড়ীটা ঘামে ভিজে চপচপ করছে।
ধর্মতলার মোড়ে যখন বাসটা থামলো,হুরহুর করে বেশ কিছু মানুষ নেমে পড়লো। দূরের একটা বসার জায়গা খালি দেখে সেদিকে পা বাড়ালো শিখন্ডী। বাসের জানালা দিয়ে একটা ফুরফুরে হওয়া বারবার ওর লম্বা চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। ছয়ফুটের একটা মানুষকে শাড়ি আর লম্বা চুলে দেখতে স্বভাবতই এখনো যে কেউ খুব একটা অভ্যস্ত নয় সেটা আর বলে দিতে হয় না। মনে মনে একটু হাসে শিখন্ডী।

“দাদা দেখি… দিনদিন একটু বার করুন…”
“শালা 10 টাকায় কি হবে রে…? দে দে ওই 50 টাকার নোটটা দে দিকি!”
পরিচিত সব গলার শব্দ…সাথে কান জ্বলিয়ে দেওয়া কুৎসিত হাতের তালি… অসহ্য!
আড় চোখে ওরই গোষ্ঠীর ভাই-বোনদের একটু দেখে নিয়ে বাইরের দিকে তাকায় শিখন্ডী। আজকাল কেমন যেন জোরজুলুম হয়ে গেছে। ও ভেবে পায় না…ওর মতো মানুষদের কেন এরকম করে টাকা রোজকার করতে হয়।

ওর এখনো মনে আছে, ছোটবেলায় ওর ব্যাপারটা লোক সমাজে জানাজানি হওয়ার পর কিছু মানুষ এসেছিল ওকে ওদের গোষ্ঠীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্ত বনলতা দেবীই একরকম জোর করে ওদের সাথে যেতে দেন নি। একবার ওই গন্ডি পেরোলে যে সেখান থেকে ফিরে আসার কোনো পথ নেই।সেই তখন থেকেই চলছে মা আর ছেলের লড়াই। স্কুলে পড়ার সময় নিজের নামের থেকে “ছক্কা” বা ” আরে ওই লেডিস” এই সম্বোধন বাণীগুলোই বেশি সরগর ছিল।

তাই স্কুলের গন্ডির পর, কলেজের পড়াশুনা সে distance থেকেই করেছে। জুওলজিতে অনার্স, তার পর মাস্টার্স.. ইচ্ছা করেই জুওলজি নিয়েছিল জানার জন্য যে শারীরিক গঠনগত দিক ছাড়া আর কি পার্থক্য থাকে সাধারণ মানুষের থেকে। কেন ওরা স্বাভাবিক জীবন বাঁচাতে পারে না?তারপর দু’বার স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়েছিল। ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করলেও চাকরিটা হয়নি তার শারীরিক গঠনগত কারণে।

ততদিনে বনলতা দেবীও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তারপর থেকেই এই যুদ্ধটা শিখন্ডীকে একাই করতে হচ্ছে … কখনো মুখ্যমন্ত্রীর সংসদে কখনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে কখনো বা সুপ্রিমকোর্টের ঘোরপাকে দিন কেটে যাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই “ওদের মতো মানুষদের সুবিচার দেওয়া”… সেই উদ্যেশ্যে আজও চলেছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী উভয়েরই সাথে একবার দেখা করতে।

সরকারি বাসের একটা জাঁদরেল ঝাঁকুনিতে মনের মধ্যে জমতে শুরু হওয়া ভাবনার জালে বেশ ভালোমতোই ব্যাঘাত পড়লো। “আরে দু’টো স্টপেজ পরেই তো শিবপুর মন্দিরতোলা…!” নিজের বসার জায়গাটা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে এগিয়ে এলো। যদিও বাসে তেমন ভিড় নেই। তাও পাশে একজন দাঁড়িয়ে থাকা এক কলেজ পড়ুয়াকে বসার জায়গা করে দেয় ও।

মিটিং সেরে বেরিয়ে আসতে আসতে মোটামুটি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। সূর্যের তাতে মাথা পুরো ঝাঁঝাঁ করছে। কাজ মিটলে তবু না হয় কথা ছিল! শিক্ষামন্ত্রী পাশে থাকলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সেভাবে মানানো গেল না।

যত দিন যাচ্ছে সব আশাগুলো কেমন যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। পাশে নিজের বলতে কেউ নেই। চোখটা একটু ঝাপসা হয়ে এলো। দু-ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ল সবার অগোচরে।

হাওড়া স্টেশন! হাওড়া স্টেশন!

নাঃ আজই ফিরে যাবে তিলচুলে। কোথাও যখন কিছু হওয়ারই নেই আর যে মানুষগুলোর জন্য এত কিছু করার চেষ্টা তাদেরই যখন কোনো হেল দোল নেই তাহলে নিজের জীবনটাকে একটু নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে আর কি!
বাসে পা-দানিতে পা’টা দিতেই যাচ্ছিলো শিখন্ডী.. হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।

অগত্যা বাসটা ছেড়ে দিয়ে একটু পাশে এসে ফোনটা ধরলো। তারপর বাকিটা ইতিহাস.. আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।

বিশ বছর পর ও এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সমাজ সেবামূলক কাজের ডিপার্টমেন্টটা হ্যান্ডল করছে। বেশ বড় পোস্ট। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। ওদের মতো মানুষদের পাশাপাশি এখন গরিব, দুঃস্থ, বৃদ্ধ মানুষ আর অসহায় মেয়েদের পাশে থাকাই ওদের সংগঠনের কাজ। তবে এখনো মাসের শেষে যখন মাহিনাটা ব্যাংক account এ ঢোকে তখন একটা খুশির সাথে সাথে পুরোনো জেদটা যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়-
“লড়াইটা যে এখনো অনেকটা বাকি..”

Loading

Leave A Comment